www.Bangla24.Top
Login - Registration - Lost Password
Homeগল্পকথার আসরসাধু ও ভূতের গল্প ‘ভূততাড়ুয়া’ – আহমেদ রিয়াজ

সাধু ও ভূতের গল্প ‘ভূততাড়ুয়া’ – আহমেদ রিয়াজ

Download Bangla.Top Android App
সাধু ও ভূতের গল্প ‘ভূততাড়ুয়া’ – আহমেদ রিয়াজ - Bangla24.Top96
অফিসের দরজা খুলে চেয়ারে এসে বসতে না বসতেই একজন এসে হাজির। অফিসটা শহরের শেষ গলি ছাড়িয়ে রাস্তার ডান দিকে। তবে বেশি দিন আর জায়গাটা শহরের বাইরে থাকবে বলে মনে হয় না। দিন দিন শহরটা চারদিকে বেড়েই চলেছে। এ এলাকায় বিদ্যুৎ আছে। কিন্তু ওই অফিসে তখন হারিকেন জ্বলছিল। তা-ও টেবিলের ওপর নয়। সিলিংয়ের দুকোনায় দুটো হারিকেন লটকে দেওয়া হয়েছে। হারিকেনের টিমটিমে আলোয় ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি হয়েছে এমনিতেই। আগন্তুককে দেখে ভূত দেখার মতোই সাধুর পিলে চমকে উঠল। কিন্তু যিনি ভূত তাড়িয়ে বেড়ান, মানুষ দেখেই কিনা তাঁর পিলে চমকে উঠল! উঠতেই পারে। কার পিলে কখন যে কী দেখে চমকায়, কেউ জানে না। তবে চমকানো পিলেকে আড়াল করার জন্য গর্জে উঠলেন সাধু, ‘কী চাই?’ প্রয়োজনের চেয়ে হাঁকটা একটু বেশি ওজনের হয়ে গেছে। ওই ওজনদার হাঁকেই ঘাবড়ে গেছেন আগন্তুক। এর মধ্যে দুবার ঢোঁক গিলে ফেলেছেন। তৃতীয় ঢোঁকটা গিলে আমতা আমতা করে বললেন, ‘ভূত…’ মেজাজের ওজন আরেকটু চড়িয়ে নিলেন সাধু। ‘ভূত! আমি তো ভূত বিক্রি করি না। ভাড়াও দিই না।’ ‘আমি জানি সাধু মহাশয়।’ বলেই অতি বিনয়ে মাথাটা সামনের দিকে একটু নুইয়ে নিলেন আগন্তুক। সাধু এবার বিভ্রান্তিতে পড়লেন। এটা কি বিনয়ে বিগলিত হওয়া, নাকি ভয়ে কাতর হওয়া? আগন্তুক এবার পিঠ টান করে বললেন, ‘আমি আপনার সাইনবোর্ড দেখেই ঢুকেছি। ওখানে বিস্তারিত লেখা আছে।’ সাধুর মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠল। আর তাতেই তিনি ওজনদার রাগটা হারিয়ে ফেললেন। মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, ‘জি। আপনি ঠিকই দেখেছেন, আমি ভূত তাড়িয়ে বেড়াই।’ ‘আপনি ভূততাড়ুয়া। ভূত তাড়ানোয় বিশেষ পারদর্শী। আপনার কথা…’ নিজের প্রশংসা শুনতে ভালো লাগলেও এখন সেটা শোনার মতো অবস্থা সাধুর নেই। অনেক দিন পর ভূত তাড়ানোর একটা কাজ পেয়েছেন। ভূতের বিস্তারিত জানার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন মনে মনে। জানতে চাইলেন, ‘ভূত তাড়ানোই আমার কাজ। তা কোথায় ভূত? বাড়িতে? নাকি হাঁড়িতে?’ পান্না-রহস্য (প্রথম পর্ব) ‘ওসব কোথাও নয়। ভূতগুলো এখনো সেকেলে। বাড়ি-হাঁড়ি কোথাও নয়, গাছে থাকে।’ খিকখিক করে ভুতুড়ে হাসি দিলেন সাধু। বললেন, ‘সঠিক জায়গাতেই আছে ওরা। গাছই হচ্ছে ভূতেদের আদি আস্তানা। ওরাই গাছের আদিনিবাসী।’ ‘তা হোক। কিন্তু ওদের উৎপাতে তো টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়েছে সাধু মহাশয়।’ ‘তা, কোন গাছে তেনারা আস্তানা গেড়েছেন? বট? শেওড়া? তেঁতুল? গাব? হিজল? আমড়া? তাল? নাকি বাঁশঝাড়ে?’ ‘কাঁঠালগাছে।’ ‘কাঁঠালগাছে!’ অবাক হলেন সাধু। ‘ভূতেরা আবার ঠিকানা বদলাতে শুরু করল কবে থেকে? কাঁঠালগাছে কখনো ভূত থাকে বলে তো শুনিনি!’ ‘মরুভূমিতে উঁচু উঁচু বিল্ডিং হবে, কে জানত। সেখানে নাকি সবজি চাষও হচ্ছে। মাটির নিচে মানুষ বাস করছে যুগ যুগ ধরে। মহাকাশেও এখন মানুষের আবাস রয়েছে। এমনকি সাগরের তলাতেও শুনেছি রিসোর্ট আছে। তো ভূতদের কাঁঠালগাছে থাকতে আপত্তি কোথায়, সাধুজি?’ মোক্ষম যুক্তি। না মেনে উপায় নেই। সাধু বললেন, ‘ঠিকই বলেছেন। মানুষেরা আবাসের বৈচিত্র্য খুঁজে বেড়ালে, ভূতেরা কী দোষ করেছে। যা–ই হোক, ওই কাঁঠালগাছের আশপাশে আর কোনো গাছ নেই?’ ‘আছে।’ ‘কী কী গাছ আছে?’ ‘বট, শেওড়া, তেঁতুল, গাব, হিজল, আমড়া, তালগাছ তো আছেই, দুটো বিশাল বাঁশঝাড়ও আছে।’ ‘তাহলে ভূতগুলো চিরায়ত আবাস ছেড়ে নতুন ধরনের গাছে কেন আস্তানা গাড়তে গেল? খুবই ইন্টারেস্টিং বিষয়!’ আধো অন্ধকারে আগন্তুকের মলিন হাসি সাধুর চোখ এড়ায়নি। কিন্তু হাসিটা একটু ভুতুড়ে ঠেকল না! দুঠোঁটে মলিন হাসি ঝুলিয়ে রেখেই আগন্তুক বললেন, ‘আপনার জন্য হয়তো ইন্টারেস্টিং, কিন্তু আমার জন্য ডিসগাস্টিং, নিদারুণ বিরক্তিকর। ওদের উৎপাতে আমার জীবন ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে।’ ‘কিন্তু কাঁঠালগাছেই আছে আপনি কী করে নিশ্চিত হলেন?’ ‘আমার গায়ে আস্ত কাঁঠাল ছুড়ে মেরেছে। একবার ভাবুন তো, কেউ আপনার গায়ে আস্ত কাঁঠাল ছুড়ে মারলে আপনার কী অবস্থা হবে?’ জাদুকরের দাঁতব্যথা খুকখুক করে কাশি দিলেন সাধু। ‘না না। যত বদখত ভূতই হোক, সাধুর গায়ে কাঁঠাল ছুড়ে মারার মতো বেয়াদব নিশ্চয়ই ওরা নয়। এতটা সাহস ওদের হবে বলেও মনে হয় না।’ ‘আপনি যদি একবার ওই গাছের নিচ দিয়ে যেতেন সাধুজি, তাহলেই টের পেতেন। আপনাকেও ওরা রেহাই দেবে না, আমি নিশ্চিত।’ আগন্তুকের আত্মবিশ্বাসের জোরে সাধুর আত্মবিশ্বাসে দুলুনি শুরু হলো। দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন, একটা ইয়া তাগড়া ভূত তাঁর গায়ে কাঁঠাল ছুড়ে মেরেছে। ভাবতেই সাধুজির শরীর কাঁঠালের মতো কাঁটা কাঁটা হয়ে গেল। ‘তা পাকা কাঁঠাল ছুড়ে মারে, নাকি কাঁচা কাঁঠাল?’ ‘কোনো বাছবিচার নেই, সাধুজি। ওই গাছের নিচ দিয়ে গেলেই হলো, হাতের নাগালে যে কাঁঠালই পাবে, ছুড়ে মারবে।’ ‘এ তো দেখছি বেশ মারদাঙ্গা ভূত। ভূতেরা এতটা মারদাঙ্গা হয় শুনিনি।’ ‘আমরাও শুনিনি সাধু মহাশয়।’ ‘এ ধরনের ভূতকে বাগে আনা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। এ জন্য বাঘা ভূততাড়ুয়া চাই।’ কাতর মিনতি জানালেন আগন্তুক, ‘সে জন্যই তো আপনার কাছে এসেছি।’ খুশি হলেন সাধু। বললেন, ‘সঠিক জায়গায় এসেছেন। জনস্বার্থে ওই কাঁঠালগেছো ভূতকে হাঁড়িতে পুরে রাখতে হবে। যাতে আর কারোর গায়ে কাঁঠাল ছুড়ে মারতে না পারে।’ ‘হাঁড়িতে পুরে রাখার দরকার নেই, সাধুজি। কেবল তাড়িয়ে দিলেই হবে।’ খুশি হলেন সাধু। হাঁড়িতে ভূত পুরে রাখা খুবই ঝামেলার। হাঁড়ির ভেতর অদ্ভুত সব শব্দ করে। ভুতুড়ে শব্দে আবার সাধুজির বড়ই অ্যালার্জি। সরু চোখে আগন্তুকের দিকে তাকালেন সাধু। বললেন, ‘ঠিক আছে। শুধু তাড়িয়েই দেব। তা গাছ থেকে তাড়ালেই হবে, নাকি এলাকা থেকেও তাড়াতে হবে?’ ‘আপনি যেটা ভালো মনে করেন।’ ‘ওই এলাকায় নারকেলগাছ আছে?’ ‘কেন?’ ‘ভাবছি, কাঁঠালগাছ থেকে তাড়িয়ে দিলে যদি আবার নারকেলগাছে আস্তানা গাড়ে আর কারোর মাথায় যদি নারকেল ছুড়ে মারে, তাহলে কী অবস্থা হবে?’ ‘তাহলে এলাকাছাড়া করতেই হবে। পারিশ্রমিক যা লাগে, আমি দেব। ওটা নিয়ে আপনি ভাববেন না।’ মিষ্টি হাসিতে সাধুর মুখটা ভরে গেল। মুখ উপচে সেই হাসি দুগাল বেয়ে কানে গিয়ে ঠেকল। অতি খুশিতে সাধুর কান দুখানা নেচে ওঠে। এখনো নাচল। গদগদ হয়ে সাধু বললেন, ‘ওই বিটকেলে ভূতকে যদি এলাকাছাড়া করতে না পারি, তাহলে আমার নাম…’ এটুকু বলেই হঠাৎ থেমে গেলেন সাধু। আগন্তুককে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। জানতে চাইলেন, ‘নাম?’ থতমত খেলেন আগন্তুক। ‘কার নাম? ভূতের? ভূতের নাম তো জানি না।’ ‘ভূত নয়, আপনার নাম।’ ‘আমার নাম ভূতেন্দ্রীয়।’ চমকে উঠলেন সাধু, ‘কী?’ ‘জি, ভূতেন্দ্রীয়।’ ‘ভূতেন্দ্রীয়? এটা আবার কেমন নাম?’ ‘নামের আবার কেমন-তেমন আছে নাকি? নাম তো নামই।’ ‘তা অবশ্য ঠিক। সার্টিফিকেটেও কি এই নাম?’ ‘সাধুজি, আমার নাম নিয়ে কথা বলার জন্য আপনার কাছে আসিনি। এসেছি কাঁঠালগাছ নিবাসী ভূতদের তাড়ানোর জন্য।’ চাঁদে যাত্রা ও চন্দ্র প্রদক্ষিণ ‘ভূতদের মানে? অনেকগুলো ভূত নাকি?’ ‘অনেকগুলো কী বলছেন, সাধুজি? এক ব্যাটালিয়ন ভূত।’ এবার ঢোঁক গিললেন সাধু। ‘এত!’ ‘জি। অনেকগুলো। শুনেছি, ওদের আরও আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবকেও খবর দেওয়া হয়েছে। ওরা নাকি রওনা হয়ে গেছে। ওরা আসার আগেই যা করার করতে হবে।’ একটু যেন দমে গেলেন সাধু, ‘একপাল ভূতের বিরুদ্ধে লড়াই! যেনতেন কথা নয়।’ জানতে চাইলেন আগন্তুক, ‘কত দিন লাগবে?’ ‘এটা নির্ভর করে কিছু বিষয়ের ওপর। এখন কি গাছে কাঁঠাল আছে?’ ‘আছে।’ অবাক হলেন সাধু। ‘বলেন কী! এখন তো কাঁঠালের মরসুম নয়।’ ‘ওটা বারোমাসি কাঁঠালগাছ।’ ‘তাহলে তো কিছুটা মুশকিল হয়ে গেল। গাছে নিশ্চয়ই কাঁঠাল আছে?’ ‘তা আছে। তবু ওদের সাঙ্গপাঙ্গ আসার আগেই কাজটা সারতে হবে। দু–এক দিনের মধ্যে সারা যাবে না?’ ‘সময়টা ভূতের ওপরও নির্ভর করে। ঘ্যাঁচড় টাইপের ভূত হলে সময় বেশি লাগবে। এ ধরনের ভূতের আবার আত্মসম্মানবোধ একবারেই নেই। ঝাড়ুর বাড়িতেও এরা অপমানিত হয় না। আত্মসম্মান আছে, এমন ভূত তাড়ানো খুব সহজ। তুড়িতেই উড়িয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু এই ভূতদের মনে হয় আত্মসম্মানবোধের ঘাটতি আছে। নইলে কাঁঠাল ছুড়ে মারত না।’ ‘ঠিকই বলেছেন।’ বলেই পকেট থেকে কয়েকটা নোট বের করলেন আগন্তুক। নোটগুলো সাধুর সামনে এগিয়ে দিলেন। বললেন, ‘২০টা নোট আছে। এটা কাজের বায়না। বাকিটা কাজ শেষ হওয়ামাত্রই পেয়ে যাবেন।’ চট করে নোটগুলো তুলে নিলেন সাধু। তারপর টেবিলের ড্রয়ার খুলে রেখে দিলেন। আগন্তুক বললেন, ‘গুনে নিলেন না?’ মুচকি হেসে সাধু বললেন, ‘দরকার নেই। ভুতুড়ে ব্যাপারস্যাপার। এখানে কেউ কাউকে ঠকায় না।’ ‘তাহলে আশা করছি দু–এক দিনের মধ্যে ভূতগুলো এলাকাছাড়া হবে।’ বলেই চলে গেলেন আগন্তুক। আগন্তুক চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন সাধু। তারপর হাঁক দিলেন, ‘ট্যাংরা!’ এবার দুই হারিকেনের মাঝখানে উদয় হলো টিংটিঙে এক ছোকরা। ‘জি ওস্তাদ!’ গুড্ডুবুড়া আসলে কে? প্রথম কবে গুড্ডুবুড়া লেখা হয়? ‘কাজ আছে। তৈরি হয়ে নে।’ ‘কী কী নিতে হবে?’ আবারও গর্জে উঠলেন সাধু, ‘কী কী নিতে হবে, জানিস না বেয়াক্কেল?’ ‘অনেক দিন পরে তো, তাই সবকিছু মনে নেই।’ ‘শর্ষে আছে?’ ‘আছে।’ ‘ঝাঁটা?’ ‘কোন ঝাঁটা? ফুলের? নাকি শলার?’ ‘আরে বেয়াক্কেল, ফুলের ঝাঁটা দিয়ে কখনো ভূত তাড়াতে দেখেছিস আমাকে? দুটো মশালও নিস সঙ্গে। প্রচুর ধোঁয়া হয়, এমন মশাল চাই।’ অবাক হলো সাধুর সহকারী। ‘মশাল কেন? ভূত তাড়াবেন, নাকি মৌমাছি তাড়াবেন?’ ‘বেশি কথা বলিস না। এবার জিনিসগুলো নিয়ে আমার সঙ্গে চল।’ পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাধুর পেছন পেছন হাঁটতে লাগল সহকারী। জানতে চাইল, ‘কোথায় যাচ্ছি, ওস্তাদ?’ ‘খুব বেশি দূরে নয়। এই কাছেই। রানীনগর। ভূতেন্দ্রীয়র বাগানবাড়ি। ভূতেরা বড্ড জ্বালাচ্ছে।’ কিছু দূর এগোনোর পর হঠাৎ থেমে গেল সহকারী। সাধু বললেন, ‘আহা! থামলি কেন?’ ‘একটা ভুল হয়ে গেছে, ওস্তাদ।’ ‘কী ভুল করেছিস আবার?’ ‘ঝোলা আনতে ভুলে গেছি। ভূত ধরে রাখব কিসে? নিয়ে আসব চটপট? এখনো তো বেশি দূর যাইনি।’ ‘ধরাধরির দরকার নেই। ভূতগুলোকে তাড়ালেই হবে।’ হাঁপ ছাড়ল ট্যাংরা। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ভূতেন্দ্রীয়র বাগানবাড়িতে এসে হাজির হলেন গুরু–শিষ্য। ভাগ্যিস আকাশে ততক্ষণে চাঁদ উঠে গেছে। পূর্ণিমা নয়, কিন্তু চাঁদের বেশ আলো। সেই আলোয় সবকিছু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বাগানটা সাজানো–গোছানো। পরিকল্পনা করেই বাগান গড়া হয়েছে। কিন্তু বাগানের ঘাসগুলো অনেক বড় হয়ে আছে। বোঝাই যায়, অনেক দিন পরিষ্কার করা হয় না। বেচারা ভূতেন্দ্রীয় নিশ্চয়ই এখানে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভূতের উৎপাতে থাকতে পারেননি। এবার পারবেন। বড় বড় ঘাস মাড়িয়ে, বাঁশঝাড় পেরিয়ে অবশেষে কাঁঠালগাছের সন্ধান পেলেন সাধু। কিন্তু এ কী! কাঁঠালগাছ তো তিনটা! কোন গাছে যে ভূতের বাসা! সাধু বললেন, ‘একটা ঝামেলা হয়ে গেল রে, ট্যাংরা।’ ‘কী ঝামেলা, ওস্তাদ।’ ‘ভূতেরা নাকি কাঁঠালগাছে আস্তানা গেড়েছে। এখানে দেখছি তিনটা কাঁঠালগাছ। কোন গাছে যে আস্তানা গেড়েছে, বুঝতে পারছি না। কী করা যায় বল তো?’ ‘নাম ধরে ডাকব নাকি, ওস্তাদ?’ ‘কার নাম ধরে ডাকবি? তোর, নাকি ভূতের?’ ‘এটা কী বলেন ওস্তাদ। আমার নাম ধরে ডাকব কেন? আমি কি ভূত? ভূতের নাম ধরে ডাকব।’ ‘কিন্তু আমি যে ভূতের নাম জানি না। এক কাজ কর, তোর নাম ধরেই ডাক। সাড়া পেলেও পেতে পারিস।’ বলেই খিকখিক করে হেসে উঠলেন সাধু। আর সেই হাসি থামার আগেই, কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘অ্যাই কে রে? নিশ্চয়ই কাঁঠাল চুরি করতে এসেছিস!’ সাধু বললেন, ‘শুনেছিস? ভূতের গলা শুনেছিস? চন্দ্রবিন্দু ছাড়া কথা বলছে। নিশ্চয়ই শিক্ষিত ভূত। শব্দটা কোন গাছ থেকে এসেছে বল তো?’ বলতে না বলতেই একটা কাঁঠাল এসে পড়ল সাধুর মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘাসের ওপর চিতপটাং হয়ে গেলেন সাধুজি। আর অমনি চেঁচিয়ে উঠলেন সাধু, ‘ওরে ট্যাংরা, মশাল জ্বালা। সাধুর মাথায় কাঁঠাল ছুড়ে মারে! কত বড় সাহস!’ দুহাতে দুটো মশাল নিয়ে সাধুর কাছে ছুটে এল ট্যাংরা। ‘ওস্তাদ, এই তো মশাল।’ ‘আরে বেয়াক্কেল, এ দুটো যে মশাল, সেটা তো আমি জানি। মশাল দুটো জ্বালা।’ ‘কিন্তু কী করে জ্বালাব, ওস্তাদ? আগুন তো আনা হয়নি।’ ততক্ষণে কাঁঠালের চোট সামলে উঠেছেন সাধু। টলতে টলতে কোনোরকমে উঠে দাঁড়ালেন। আর দাঁড়িয়েই ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলেন ট্যাংরার গালে। ‘ব্যাটা বেয়াক্কেল, মশাল জ্বালাতে আগুন লাগে, জানিস না?’ সাধুর হাতে এত জোর! দাঁত নড়ে গেছে কি না, কে জানে। গালে হাত দিয়ে কোনোরকমে ট্যাংরা বলল, ‘ভূতের সামনে এ রকম অপমান করা কি ঠিক হলো, ওস্তাদ?’ সাধুর রাগ তখনো চরমে। দাঁতে দাঁত পিষে বললেন, ‘তোকে জুতা পেটা করা উচিত। তোর ভাগ্য ভালো আমি জুতা পরি না। ঝাঁটা বের কর!’ ঘাবড়ে গেল ট্যাংরা। ‘ঝাঁটা কেন, ওস্তাদ? ঝাঁটাপেটা করবেন নাকি?’ ‘এ ছাড়া আর কী করার আছে। ঝাঁটায় কাজ না হলে…’ ‘ওস্তাদ, এত বছর আপনার সঙ্গে কাজ করছি। কোনো দিন কি ঝাঁটাপেটা খাওয়ার মতো কাজ করেছি? আজ ভুল করে আগুন আনিনি বলে ঝাঁটাপেটা করবেন?’ ‘আরে বেয়াক্কেল, তোকে নয়, ভূতগুলোকে ঝাঁটাপেটা করব। ঝাঁটা দে!’ বলেই হাত বাড়ালেন সাধু। আর তখনই ট্যাংরার হাতের ওপর এসে পড়ল আরেকটা কাঁঠাল। ‘উফ্! গেলাম রে। বাঁচাও! ভূত!’ চিৎকার করতে করতে ছুট দিল ট্যাংরা। রানির মুকুট রহস্য ভীষণ রেগে গেলেন সাধু। না, রাগটা ট্যাংরার ওপর নয়, ভূতের ওপর। অনেক ভূতই তো জীবনে তাড়িয়েছেন, কিন্তু এতটা মারদাঙ্গা ভূতের কবলে আগে কখনো পড়েননি। আজই বুঝলেন, ভূত তাড়ানো আসলে এত সহজ কাজ নয়। এত দিন গোবেচারা নিরীহ ভূত তাড়িয়েছেন। তাই টের পাননি। আরও টের পেলেন, যখন তাঁর মাথার ওপর আরেকটা কাঁঠাল এসে পড়ল। কাঁঠালটা আবার আকারে বিশাল। কাঁঠালের ঘায়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি সাধু। বড় বড় ঘাসের ওপর চিত হয়ে পড়ে গেলেন। আর পড়েই স্থির হয়ে রইলেন। সাধুজির কানে তখন ট্যাংরার কণ্ঠ ভেসে এল, ‘ওস্তাদ, চোখ খুলুন। চোখ খুলুন, ওস্তাদ।’ ট্যাংরার ডাকে চোখ মেলে তাকালেন সাধু। তাঁর চোখের সামনে ট্যাংরার উদ্বিগ্ন চেহারা। তখনো সূর্য ওঠেনি। পূর্ব আকাশ কেবল কমলা হয়ে উঠেছে। তবে চারপাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আর দেখা যাচ্ছে ট্যাংরার মুখ। হঠাৎ কী মনে হতেই ধড়মড় করে উঠে বসলেন সাধু। ঘাসের ওপর এদিক–ওদিক তাকালেন। ট্যাংরা বলল, ‘ওস্তাদ, কিছু খুঁজছেন?’ ‘হুম। কাঁঠাল।’ ‘কাঁঠাল!’ ‘আরে বেয়াক্কেল, রাতের বেলা ভূতেরা আমাদের গায়ে কাঁঠাল ছুড়ে মেরেছিল, মনে নেই?’ ‘মনে থাকবে না আবার! খুব মনে আছে। আমার হাতের কবজি ফুলে গেছে। দেখেন?’ বলেই ডান হাতটা এগিয়ে দিল সাধুর দিকে। রাগে ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন সাধু। বললেন, ‘আর আমার যে মাথা ফুলে গেছে, সেটা তোর চোখে পড়েনি?’ ‘পড়েছে ওস্তাদ।’ ‘কিন্তু ভাঙা কাঁঠাল গেল কোথায়?’ এবার খিকখিক করে হেসে উঠল ট্যাংরা। বলল, ‘বুঝেছি। এই ভূতেরা পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খায়। তাই আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেয়ে নিয়েছে।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সাধু। বললেন, ‘সেটাই তো দেখতে পাচ্ছি রে ট্যাংরা। চল।’ ‘কোথায় যাব, ওস্তাদ?’ দাঁতে দাঁত পিষে সাধু বললেন, ‘আমি এর শেষ দেখে ছাড়ব। হুহ্! সাধুর মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া?’ বলেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন সাধু। আর ট্যাংরা ছুটল তাঁর পেছন পেছন। হাঁটতে হাঁটতে রানীনগর গ্রামে এলেন দুজন। একজনকে জিজ্ঞেস করলেন সাধু, ‘ভূতেন্দ্রীয়র বাড়িটা কোথায়, বলতে পারবেন?’ ‘এদিক দিয়ে সোজা এগিয়ে যাবেন, তারপর বাঁ দিকে একটা বাগান আছে। সেই বাগানের শেষ মাথায়। ছাড়াবাড়ি। গাছপালায় আড়াল হয়ে আছে।’ বলেই ডান হাতের তর্জনী দিয়ে রাস্তা দেখিয়ে দিলেন। সেই পথে হাঁটতে লাগলেন দুজন। হাঁটতে হাঁটতে ট্যাংরা বলল, ‘এ পথ দিয়েই তো এসেছি, ওস্তাদ। কিন্তু কোনো বাড়ি চোখে পড়েনি যে!’ সাধু বললেন, ‘কী বলল শুনলি না? গাছপালায় আড়াল হয়ে আছে। তাই আমাদের চোখে পড়েনি।’ তারপর আবার সেই বাগান পেরিয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে ভূতেন্দ্রীয়র বাড়ির দেখা পেলেন তাঁরা। বাড়ির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন দুজনই। ট্যাংরা বলল, ‘ওস্তাদ, বাড়িটাকে ভুতুড়ে বাড়ির মতো লাগছে।’ সাধু বললেন, ‘খুব স্বাভাবিক। ভুতুড়ে বাড়ি তো হবেই। ভূতের উৎপাতে বাড়িতে মানুষ থাকতে পারে?’ ‘মনে হচ্ছে বাড়িতে কেউ নেই।’ ‘থাকলেই বরং অবাক হব।’ বলেই হাঁক দিলেন সাধু, ‘ও ভূতেন্দ্রীয়, আছেন নাকি বাড়িতে?’ হাঁক দিতে না দিতেই হঠাৎ চার চোখের সামনে উদয় হলেন এক থুত্থুড়ে বুড়ো। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন, নাকি গাছ থেকে পড়লেন, ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি সাধু। বুড়োকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়েও থেমে গেলেন সাধু। বুড়োই তাঁদের দুজনকে আপাদমস্তক দেখে নিচ্ছেন। যদিও ট্যাংরার মনে হলো চেখে নিচ্ছেন। সাধুর ডান কপালে আঘাতের দাগ তখনো দেখা যাচ্ছে। ওই দাগের দিকে তাকিয়ে যেন মুচকি হাসলেন বুড়ো। তারপর অদ্ভুত ধরনের খনখনে কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘কী চাই?’ ঘাবড়ে গিয়ে মুখ খুলল ট্যাংরা, ‘ভূ…ভূত!’ বিরক্ত হলেন বুড়ো। বললেন, ‘ভূত? এ বাড়িতে ভূত থাকে না। ভূত থাকে ওই বাগানে। কাঁঠালগাছে।’ বলেই সেই বাগানটাই আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন বুড়ো। সাধু বললেন, ‘ভূত নয়, আমরা ভূতেন্দ্রীয়র খোঁজে এসেছি।’ অবাক হয়ে সাধুর দিকে তাকিয়ে বললেন বুড়ো, ‘ওই একই কথা হলো। ভূতেন্দ্রীয় তো সেই কবে ভূত হয়ে গেছে।’ ‘মরে ভূত হয়েছে?’ ‘না। মরে ভূত হলে তো ভালোই হতো।’ ‘তাহলে?’ ‘সাধনা করে ভূত হয়েছে।’ ‘সাধনা করে!’ আরও অবাক হলেন সাধু। ‘সাধনায় ভূত হওয়া যায়?’ ‘কেন যাবে না? সাধনা করে যদি সাধু হওয়া যায়, ভূতও হওয়া যায়।’ ট্যাংরা জানতে চাইল, ‘কাঁঠালগাছে কি সত্যিই ভূত আছে?’ ‘আছে তো। এটা সবাই জানে। তাই ওই গাছের কাঁঠাল কেউ খায় না। খাবে কি, কাঁঠাল তো পাকেও না।’ মাথায় হাত বুলিয়ে সাধু জানতে চাইলেন, ‘পাকে না কেন? ‘পাকার সময় পায় না। তার আগেই ভূতেরা গাছ থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে গায়ে ছুড়ে মারে।’ ‘কার গায়ে ছুড়ে মারে?’ ‘সামনে যাকেই পায়, তাকেই ছুড়ে মারে—ভূত হোক আর মানুষ হোক। ওই কাঁঠালগাছ নিয়েই দুদল ভূতের ঝগড়া চলছে বেশ কিছুদিন। দুদল ভূতই গাছের দখল চায়। যদিও আগে এটা ভূতেন্দ্রীয়র দলের দখলে ছিল। কিন্তু এখন সেটা আরেকটা ভূতের দখলে।’ ট্যাংরার দিকে তাকিয়ে সাধু বললেন, ‘সাধনা করে সাধু হওয়া অনেক বড় ব্যাপার। আর ভূত হওয়া সামান্য ব্যাপার। বুঝলি ট্যাংরা? এবার চল।’ অফিসে বসে আছেন সাধু। বসে বসে ভাবছেন। এমন ভূতের পাল্লায় পড়বেন, কখনো ভাবেননি। কিন্তু এ কী! গেস্টহাউসের রহস্য হঠাৎ হারিকেন দুটোর আলো ধপ করে নিভে গেল। আবছা একটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল পুরো অফিসঘর। আর সেই আবছা অন্ধকারে কে যেন তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। চেঁচিয়ে উঠলেন সাধু, ‘কে?’ ‘ভয় পাবেন না সাধু মহাশয়, আমি ভূতেন্দ্রীয়।’ চমকে উঠলেন সাধু, ‘ভূতেন্দ্রীয়! এখানে কী চাই?’ ‘ভূত তো তাড়াতে পারলেন না। আমার টাকাগুলো ফেরত দিন।’ রেগে গেলেন সাধু, ‘আমার সঙ্গে মশকরা?’ ‘মশকরার কী হলো? আমার টাকা ফেরত দেবেন না?’ ‘দিচ্ছি। এই নে…’ বলেই টাকার বদলে শলার ঝাঁটা বের করলেন সাধু। আর তখনই হঠাৎ নিভে যাওয়া হারিকেন দুটো জ্বলে উঠল ধপ করে। সুন্দর একটা ভুতুড়ে আলোয় ভরে গেল ঘরটা। সামনে তাকালেন সাধু। নেই। আশপাশে তাকালেন। নেই। পুরো ঘরে আর কেউ নেই।

Related Posts

Categories #9

খবরাখবর(902)
ছোট গল্প(68)
শিক্ষামূলক গল্প(67)
গল্পকথার আসর(59)
ভৌতিক গল্প(57)
ইসলামিক গল্প(44)
কিশোর গল্প(32)
রম্য গল্প(21)
চটি গল্প(1)